নিজস্ব প্রতিনিধি: পদ্মা সেতুর কল্যাণে ২৫ জুনের পর তাজা ইলিশ পাবে রাজধানীসহ আশপাশে। ফেরিসহ নানা ঝক্কির কারণে সিলেট, কুমিল্লাসহ যেসব অঞ্চলে আগে ইলিশ পাঠানো যেত না, সেসব জায়গায় মাছ পাঠানোর কথা ভাবছে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা।
কমবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও। ফলে পদ্মা সেতুকে ঘিরে নড়েচড়ে বসেছে দক্ষিণের মৎস্য খাত। মাছ দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরুর কথাও জানিয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসির কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন!
মৎস্যসম্পদে বরাবরই সমৃদ্ধ ধান-নদী-খালের বরিশাল। মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, দেশে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৬ ভাগেরই জোগান দেয় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ৪ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন ইলিশের মধ্যে বরিশালের ৬ জেলা থেকেই আহরিত হয়েছে ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ মেট্রিক টন ইলিশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ভোলা জেলায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৩২ টন এবং বরগুনা জেলায় ৭০ হাজার ২৩৭ টন। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে দেশের ইলিশ খাতে বরিশালের অবদান।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে কেবল বরিশাল জেলায়ই উৎপাদিত হয় ৪২ হাজার ৩৮৮ টন ইলিশ, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে তা দাঁড়ায় ৫১ হাজার মেট্রিক টনে।
বরিশাল আঞ্চলিক মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কেবল ইলিশই নয়, সব ধরনের মাছ উৎপাদনেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এগিয়ে বরিশাল। গত অর্থবছরে বরিশাল অঞ্চলের ৬ জেলায় ইলিশসহ মোট উৎপাদিত অন্যান্য মাছের পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ টন।
আরও পড়ুন: অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত
ছাত্রলীগ নেতার জন্মদিন উপলক্ষে পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ
এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪০ টনের স্থানীয় চাহিদা পূরণ শেষে এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় ২ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন মাছ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করা পরিবেশ ফেলো মুরাদ আহম্মেদ বলেন, ‘এই যে মৎস্য উৎপাদনের হিসাব, এখানে বেশ কয়েকটি সূচক রয়েছে যা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য গর্বের। গত অর্থবছরে এই অঞ্চলে যেখানে মোট উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার টন, সেখানে ইলিশই কিন্তু ৩ লাখ ৩০ হাজার টনের কাছাকাছি।
তাছাড়া এই অঞ্চলে উৎপাদিত ইলিশসহ অন্যান্য মাছের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এসব মাছের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক উৎস থেকে। এখানে চাষের মাছের পরিমাণ খুবই সামান্য। যে কারণে এই অঞ্চলের অন্যান্য মাছের পাশাপাশি ইলিশের স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা।
বলা যায় যে, এই অঞ্চলেই উৎপাদিত হয় দেশ তথা বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশ। যে কারণে বরিশালের ইলিশের চাহিদা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও আকাশচুম্বী। যখনই বিদেশে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি মেলে তখনই দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বরিশালের ইলিশ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।’
এফবিসিসিআইর পরিচালক এবং বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট নিজামউদ্দিন বলেন, ‘আড়াআড়িভাবে বয়ে যাওয়া পদ্মা আমাদের বরিশাল অঞ্চলকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এই কারণে আমরা যে কতটা পিছিয়ে ছিলাম তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে মৎস্য খাত।
দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী অঞ্চল হয়েও আমরা পাইনি ইলিশের মালিকানা। আমাদের ইলিশ আমাদের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে লাভের অংশ খেয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাজধানীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে পরিবহণে ঝুঁকি থাকায় কষ্টার্জিত ইলিশ আমরা তুলে দিয়েছি তাদের হাতে। ফেরি পারাপারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে কখনো কখনো ঢাকা পর্যন্ত ইলিশ পৌঁছাতে লেগে যেত ২-৩ দিন সময়। এখন আর থাকবে না কষ্টের দিন।’
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘সিজনে কেবল পাথরঘাটা থেকেই প্রতিদিন ইলিশ ভর্তি ৫০টির বেশি ট্রাক যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। একেকটি ট্রাকে যদি ১৫ টন করেও ধরা হয় তাহলে দৈনিক এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫০ টন। এভাবে দক্ষিণের অন্তত ৩৮টি মোকামে থেকে যায় ইলিশ। নদী-সাগর থেকে ধরে আনার পর আমরা ইলিশ বেঁচে দিই দালালদের কাছে।
পাবনা, যশোর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এরা এসে বসে থাকে আমাদের কাছে। পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাছ পাঠানো প্রশ্নে পচে যাওয়াসহ নানা ঝুঁকি থাকায় আমরাও মাছ দিয়ে দিই তাদের। পরে খবর পাই, যে দামে আমরা বিক্রি করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি দামে তারা ছেড়েছে বাজারে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই জটিলতা আর থাকবে না।
উপকূল থেকে দিনে দিনে মাছ নিয়ে রাজধানীতে গিয়ে বিক্রি করে আবার বাড়িতে ফিরে আসতে পারব আমরা। কেনাবেচার মাঝে যারা দালালি খেত তাদেরও আর দিতে হবে না বাড়তি টাকা। তাছাড়া এত বছর ধরে ৩-৪ দিনের বাসি ইলিশ খেত যে রাজধানীর মানুষ তারাও এখন দিনে দিনেই পেয়ে যাবে টাটকা ইলিশ।’
ব্রিজ চালু হলে ইলিশের সঠিক মূল্য পাব আমরা। আয়ও বাড়বে। সেক্ষেত্রে আর থাকবে না অভাব দারিদ্র্য। পদ্মা সেতু যে আমাদের জন্য কত বড় আশীর্বাদ সেটা কেবল আমরা বুঝি। বরিশাল থেকে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল এই পদ্মা পাড়ি। ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে টনকে টন মাছ পচেছে আমাদের। আল্লাহর অসীম রহমত এবং প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক চেষ্টায় আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের মৎস্য সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়ন হবে।
রাজধানীসহ সারা দেশে খুব কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে আমাদের ইলিশ। এতে করে একদিকে যেমন অপেক্ষাকৃত তাজা ইলিশ পাবে দেশের মানুষ, তেমনি আমাদের মৎস্যনির্ভর অর্থনীতিও হবে আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।